Wednesday , December 10 2025
👁️ আজকের ভিউ: 547 | মোট ভিউ: 79,798
অর্পিত সম্পত্তি

vested property | অর্পিত সম্পত্তি

আইন-শব্দকোষ

আইন-শব্দকোষ এর সূচীপত্রে ফিরে যেতে এখানে ক্লিক করুন।

অর্পিত সম্পত্তি

অর্পিত সম্পত্তি (vested property) বাংলাদেশের ভূমি আইনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল ধারণা, যার উৎপত্তি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। প্রাথমিকভাবে ‘শত্রু সম্পত্তি’ নামে পরিচিত এই সম্পত্তির ধারণাটি ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান ‘অর্পিত সম্পত্তি’তে রূপ নিয়েছে।

পটভূমি ও প্রাথমিক ঘোষণাঃ

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে, পাকিস্তান সরকার একটি বিশেষ পদক্ষেপ নেয়। যেসব ব্যক্তি পাকিস্তানকে (তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) ত্যাগ করে ভারতে বসবাস করছিলেন, তাদের রেখে যাওয়া সকল সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের সময় শত্রুদের সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। একই দিনে, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ‘পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ’ জারি করে। এই অধ্যাদেশের ৩ ধারার ক্ষমতা ব্যবহার করে ‘পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা’ প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালার ১৮২ বিধির (১) (বি) উপবিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর ১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর একটি আদেশ জারি করেন। এই আদেশে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, বিধিমালা অনুযায়ী ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত সকল জমি, সেগুলোর উপরে অবস্থিত ভবন এবং সকল অস্থাবর সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তির উপ-তত্ত্বাবধায়ক’ বরাবর ন্যস্ত হবে। অর্থাৎ, এসব সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সরকারের প্রতিনিধির হাতে চলে আসে।

হস্তান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞাঃ

১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে উপ-তত্ত্বাবধায়কের কাছে ন্যস্ত হওয়া এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর বিক্রয়, বিনিময়, দান, উইল, বন্ধক, ইজারা, উপ-ইজারা বা অন্য কোনো প্রকারের হস্তান্তর সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। যদি এই আদেশের পরিপন্থী কোনো প্রকার হস্তান্তর করা হতো, তবে তা অবৈধ ও অকার্যকর বলে গণ্য হতো। এর অর্থ হলো, একবার শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর, সেগুলোর মালিকানা ব্যক্তিগতভাবে আর হস্তান্তর করা যেত না।

প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনাঃ

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১৯৬৬ সালের ৮ জানুয়ারি ‘১৯৬৬ সালের পূর্ব পাকিস্তান শত্রু সম্পত্তি (জমি ও ইমারত) প্রশাসন ও নিষ্পত্তিকরণ আদেশ’ জারি করেন। এই আদেশে শত্রু সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক, উপ-তত্ত্বাবধায়ক এবং সহকারী তত্ত্বাবধায়কদের অনধিক এক বছরের জন্য এসব সম্পত্তি ইজারা (লিজ) দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

এই আদেশে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়ঃ

  • ১) পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ বিভাগের পরিচালককে শত্রু সম্পত্তির উপ-তত্ত্বাবধায়ক (জমি ও ইমারত) হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
  • ২) জেলা প্রশাসকদের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
  • ৩) পরবর্তীকালে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এবং মহকুমা প্রশাসকদেরও সহকারী তত্ত্বাবধায়করূপে নিয়োগ করা হয়, যা মাঠ পর্যায়ে সম্পত্তির প্রশাসনিক ক্ষমতাকে আরও বিস্তৃত করে।

আইনের ধারাবাহিকতা ও নতুন অধ্যায়ের সূচনাঃ

১৯৬৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর ‘পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ’ এবং ‘পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা’র কার্যকারিতা ও বৈধতা সাময়িকভাবে রহিত হয়ে যায়। তবে, শত্রু সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘শত্রু সম্পত্তি (জরুরি বিধানসমূহের ধারাবাহিকতা) অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশটি শত্রু সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত এর কার্যকারিতা অব্যাহত থাকে।

‘অর্পিত সম্পত্তি’তে রূপান্তরঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, শত্রু সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৭৪ সালে ‘শত্রু সম্পত্তি (জরুরি বিধানসমূহের ধারাবাহিকতা রক্ষাকরণ (রহিতকরণ) আইন’ পাশ করা হয়। এই আইনটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক বরাবর ন্যস্ত সকল শত্রু সম্পত্তি এই আইনবলে সরাসরি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট অর্পিত হয়। এই আইনের মাধ্যমেই ‘শত্রু সম্পত্তি’র (vested property) নতুন নামকরণ হয় ‘অর্পিত সম্পত্তি’

এরপর, ১৯৭৬ সালে এই আইনটি আরও সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশে সুস্পষ্টভাবে বলা হয় যে, সরকারে অর্পিত সকল শত্রু সম্পত্তির প্রশাসন, নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা, হস্তান্তর ইত্যাদি সকল ক্ষমতা সরকার অথবা সরকার-নির্দেশিত যেকোনো কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত করা হলো। এর মাধ্যমে সরকার অর্পিত সম্পত্তির (vested property) উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।

অর্পিত সম্পত্তির সংজ্ঞা ও আইনি ব্যাখ্যাঃ

একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি ব্যাখ্যা হলো, ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ‘শত্রু সম্পত্তি’র সংজ্ঞায় যে সম্পত্তি পড়ে, তা ব্যতীত অন্য কোনো সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। এটি অর্পিত সম্পত্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড।

পরবর্তীতে, ২০০১ সালে ‘অর্পিত সম্পত্তি-প্রত্যর্পণ আইন’ প্রণীত হয়, যার ২৯এ ধারা অনুসারে, ‘অর্পিত সম্পত্তি’ (vested property) অর্থ অর্পিত সম্পত্তি আইনের অধীনে সরকারে ন্যস্ত সম্পত্তি। এই আইনটি মূলত অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য তৈরি হয়েছিল।

সংক্ষেপে, অর্পিত সম্পত্তি (vested property) হলো এমন এক ধরনের সম্পত্তি যা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলস্বরূপ প্রথমে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল এবং পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘অর্পিত সম্পত্তি’ (vested property) হিসেবে সরকারের দখলে আসে। এর আইনি প্রক্রিয়া ও জটিলতা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে রেখেছে।

প্রশ্ন ১: অর্পিত সম্পত্তি (Vested Property) বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: অর্পিত সম্পত্তি বলতে এমন সম্পত্তি বোঝায় যা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সেই সম্পত্তিগুলো নিজের তত্ত্বাবধানে নেয়। পরবর্তীতে এই সম্পত্তিগুলোকে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নামে অভিহিত করা হয়।

প্রশ্ন ২: ‘অর্পিত সম্পত্তি’ ধারণার উৎপত্তি কোথা থেকে?

উত্তর: এর উৎপত্তি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার ভারতগামী নাগরিকদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার সেই সম্পত্তিগুলোকে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ বলে অভিহিত করে।

প্রশ্ন ৩: ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় সরকার কেন শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করেছিল?

উত্তর: যুদ্ধকালীন সময়ে নিরাপত্তার স্বার্থে পাকিস্তান সরকার মনে করেছিল যে ভারতের নাগরিক বা তাদের অনুগত ব্যক্তিদের সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। তাই এগুলোকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

প্রশ্ন ৪: শত্রু সম্পত্তির উপর হস্তান্তর কেন নিষিদ্ধ ছিল?

উত্তর: শত্রু সম্পত্তির মালিকরা পাকিস্তান ত্যাগ করায় এসব সম্পত্তি সরকারের তত্ত্বাবধানে চলে যায়। তাই বিক্রয়, দান, ইজারা, উইল বা অন্য যেকোনো হস্তান্তর আইনি দিক থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

প্রশ্ন ৫: স্বাধীনতার পর কীভাবে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ‘অর্পিত সম্পত্তি’তে পরিণত হয়?

উত্তর: ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার “শত্রু সম্পত্তি (জরুরি বিধানসমূহের ধারাবাহিকতা রহিতকরণ) আইন” পাস করে। এই আইনের মাধ্যমে শত্রু সম্পত্তিগুলো সরাসরি বাংলাদেশের সরকারের কাছে অর্পিত হয় এবং নতুন নামে পরিচিত হয়—‘অর্পিত সম্পত্তি’।

প্রশ্ন ৬: অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: সরকার এই সম্পত্তিগুলোর প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, লিজ, হস্তান্তর ইত্যাদি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার নির্ধারিত তত্ত্বাবধায়ক ও উপ-তত্ত্বাবধায়কদের মাধ্যমে এসব সম্পত্তি পরিচালিত হয়।

প্রশ্ন ৭: ২০০১ সালের ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন’-এর উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেসব অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের থেকে অন্যায়ভাবে সরকারে ন্যস্ত হয়েছিল, সেগুলো তাদের নিকট পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া।

প্রশ্ন ৮: অর্পিত সম্পত্তি নির্ধারণের সময়কাল কোনটি?

উত্তর: ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল, সেগুলোকেই পরবর্তীতে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রশ্ন ৯: অর্পিত সম্পত্তি আইন কারা প্রণয়ন করেছিলেন?

উত্তর: প্রথমে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ চলাকালে “শত্রু সম্পত্তি আইন” জারি করেছিল। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে আইনটি পরিবর্তন করে “অর্পিত সম্পত্তি আইন” নামে প্রণয়ন করে।

প্রশ্ন ১০: অর্পিত সম্পত্তির আইনি গুরুত্ব কী?

উত্তর: এটি বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা, সম্পত্তি মালিকানা এবং আইনগত ন্যায্যতা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন ভূমি প্রশাসন, আদালত ও নাগরিক অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
YouTube Playlist Embed (No Gap Fix)

সাম্প্রতিক প্রকাশিত লেকচারসমূহ

আমাদের সেবাসমূহ

প্রয়োজনীয় সরকারি লিংক

📱 অ্যাপ ডাউনলোড করুন — দ্রুত

অ্যাপ ইন্সটল করে সবকিছু এক জায়গায় দেখুন।

Check Also

abandoned property

abandoned property | পরিত্যক্ত সম্পত্তি

আইন-শব্দকোষ মূল পাতায় ফিরে যান আইন-শব্দকোষ এর সূচীপত্রে ফিরে যেতে এখানে ক্লিক করুন। পরিত্যক্ত সম্পত্তিঃ …

অর্পিত সম্পত্তি

vested property | অর্পিত সম্পত্তি

আইন-শব্দকোষ মূল পাতায় ফিরে যান আইন-শব্দকোষ এর সূচীপত্রে ফিরে যেতে এখানে ক্লিক করুন। অর্পিত সম্পত্তি …

আপনার মূল্যবান মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Table of Contents

Index