Friday , March 29 2024

আপনি জানেন কি গর্ভপাত একটি দন্ডনীয় অপরাধ?

গর্ভপাত কি?

সাধারনভাবে কোন নারীর গর্ভস্থ ভ্রুণ নষ্ট করাকে গর্ভপাত বলা হয়। যদি কোন নারীর গর্ভে ভ্রুণ সৃষ্টির পর থেকে গর্ভকাল পূরন হওয়ার আগেই গর্ভস্থ ভ্রুণ অপসারণ করা হয় তাহলে তাকে গর্ভপাত বলে। বাংলাদেশে গর্ভপাতকে শর্তসাপেক্ষে (যেমন-গর্ভবতী নারীর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে) বৈধতা দেয়া হয়েছে। এই শর্ত ব্যতীত দন্ডবিধি অনুযায়ী নারীর সম্মতি সহকারে কিংবা সম্মতি নিয়ে যে কোন প্রকারেই হোক না কেন সকল প্রকার গর্ভপাত অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় গর্ভপাতের জন্য বিভিন্ন শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ

ভ্রূণ অবস্থায় গর্ভপাত ঘটালে কি হবে?

দণ্ডবিধির ৩১২ নং ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো নারীর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্য ছাড়া, অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় উক্ত নারীর গর্ভপাত ঘটায় তবে তিনি অপরাধী সাব্যস্ত হবেন এবং এই অপরাধের জন্য শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

আইনগত ব্যাখ্যাঃ ভ্রূণ হত্যা খুনের শামিল৷ গর্ভধারিণীর সম্মতি নিয়ে অথবা তার বিনা সম্মতিতে যে ভাবেই করা হোক না কেন, জীবন রক্ষার উদ্দেশ্য ছাড়া যে নারী নিজের থেকে অকাল গর্ভপাত করে সে অপরাধী বলে বিবেচিত হবে।

গর্ভস্থ শিশু সচল হয়ে ওঠার পর গর্ভপাত ঘটালে কি হবে?

দণ্ডবিধির ৩১২ ধারা অনুযায়ী উক্ত গর্ভপাতকারীর শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড এবং একই সঙ্গে অর্থদণ্ড।

আইনগত ব্যাখ্যাঃ গর্ভস্থ শিশু সচল হয়ে ওঠার পর গর্ভপাত ঘটালে যে ব্যক্তি উহা করবেন তিনি অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন৷ নিজেই নিজের গর্ভপাত ঘটালে গর্ভধারিণী নারীও এই ধারার আওতায় আসবেন।

নারীর সম্মতি ব্যতীত গর্ভপাত ঘটালে কি হবে?

দন্ডবিধির ৩১৩ ধারা মতে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া তার জীবন রক্ষার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য যে কোনো কারণে উক্ত নারীর গর্ভপাত ঘটান তবে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা দশ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে একই সাথে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

আইনগত ব্যাখ্যাঃ এই ধারায় নারীর সম্মতি ব্যতীত গর্ভপাতকরণের অপরাধের জন্য দন্ডের কথা বলা হয়েছে। সমাজে এমনো দেখা যায়, অবৈধ সহবাসের ফলে গর্ভ সঞ্চয়ের পর ভ্রমররূপী পুরুষ তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে এবং গর্ভস্থ শিশুর পির্তৃত্ব অস্বীকার করে৷ বৈধ পন্থায় এই সমস্যার সমাধান না করে মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে অথবা অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে গর্ভীনির ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক গর্ভপাত ঘটায়। এইরূপ ক্ষেত্রে যারা জোরপূর্বক গর্ভপাত ঘটায় তাদের সকলের শাস্তি হওয়া উচিত। চিকিত্‍সক, যিনি গর্ভপাত সম্পন্ন করেছেন তিনিও অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন। কেননা গর্ভপাত করার পূর্বে তিনি দেখে নিবেন গর্ভপাত করার যথেষ্ট সংগত কারন আছে কি না। তদুপরি গর্ভীণির লিখিত সম্মতি নিতে হবে৷ নতুবা গর্ভপাত করাতে পারবেন না।

গর্ভপাত করার উদ্দেশ্যে সম্পাদিত কার্যের ফলে নারীর মৃত্যু ঘটলে কি হবে?

দন্ডবিধির ৩১৪ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটানোর উদ্দেশ্যে এমন কোনো কাজ করে, যাতে সে নারীর মৃত্যু ঘটে তবে উক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ দশ বছর কারাদন্ড এবং একই সঙ্গে অর্থদেন্ড দন্ডিত হবেন। নারীর সম্মতি ছাড়াই উপরোক্ত গর্ভপাতের চেষ্টার ফলে যদি নারীর মৃত্যু ঘটে তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে অথবা উপরোক্ত দন্ডে দন্ডিত হবেন।

আইনগত ব্যাখ্যাঃ গর্ভপাত করাতে গিয়ে গর্ভীনির মৃত্যু ঘটলে এই ধারার অপরাধ অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। যে কাজ তিনি করেছেন তার দ্বারা যে মৃত্যু ঘটতে পারে, এই সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকলেও চলে৷ গর্ভপাত করার উদ্দেশ্য নিয়ে যে কাজ করা হয়, সেই কাজের ফলে যদি গর্ভীনি মারা যায় তবে যিনি গর্ভপাত করার উদ্দেশ্যে কোন কাজ করেছিলেন তিনি শাস্তি পাবেন। তিনি এই বলে রেহাই পাবেন না যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যু ঘটান নাই বা তিনি যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন বা গর্ভীনিকে রক্ষা করতে পারেন নাই বা তিনি তার কার্যের পরিমান সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন না।

এজাহার দায়েরের মাধ্যমে কিভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে?

এই ধরনের মামলা থানায় এজাহার দায়েরের মাধ্যমে করতে হয়৷ আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার নিকটবর্তী থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার কাছে গিয়ে আপনার অভিযোগ সম্পর্কে বলুন।

আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে কিভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে?

যদি কোন কারনে থানায় এজাহার দায়ের করা সম্ভব না হয় তবে সেক্ষেত্রে আপনি থানায় যে কারনে মামলাটি গ্রহন করা হয়নি সেই কারন থানা কর্তৃক নির্দিষ্ট ফরমে লিপিবদ্ধ করে নিয়ে অভিযোগ (আরজি) দাখিলের মাধ্যমে সরাসরি ভ্রুন অবস্থায় গর্ভপাত ঘটানোর জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট বা প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে এবং গর্ভস্থ শিশু সচল হয়ে ওঠার পর গর্ভপাত ঘটানোর জন্য দায়রা আদালত, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট, জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট বা সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। নারীর সম্মতি ব্যতীত গর্ভপাত ঘটানোর জন্য দায়রা আদালতে এবং গর্ভপাত করার উদ্দেশ্যে সম্পাদিত কার্যের ফলে নারীর মৃত্যু ঘটনোর জন্য চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট, জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট বা সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন।

কি কি বিষয় মামলার আরজিতে উল্লেখ করতে হবে?

  • যে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে তার নাম;
  • ফরিয়াদীর নাম, বসবাসের বর্ণনা এবং স্থান;
  • আসামীর নাম, বসবাসের বর্ণনা এবং স্থান, যতদূর তা নির্ণয় করা যায়;
  • ফরিয়াদী বা আসামী মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে সে মর্মে বিবৃতি;
  • যে সকল ঘটনার দরুন মামলার কারন উদ্ভব হয়েছে বা যেই সময় তা হয়েছে সে সম্পর্কীত বিবরণ;
  • আদালতের এখতিয়ার আছে বলে প্রমাণকারী তথ্যসমূহ;
  • ফরিয়াদী যে প্রতিকার দাবী করে সে সম্পর্তীত বিবরণ;
  • নালিশের কারন সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে;
  • মামলার এখতিয়ার এবং কোর্ট ফি’র উদ্দেশ্যে মামলার বিষয়বস্তুর মূল্য যতদূর স্বীকার করা হয় সেই সম্পর্কে একটি বিবৃতি।

আদালতে কি কি বিষয় প্রমাণ করতে হবে?

দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবশ্যই আদালতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এগুলো হলোঃ

  • যে নারীর গর্ভপাত ঘটানো হয়েছিল সে নারী গর্ভবতী ছিলেন এবং তিনি ভ্রূণের চলাচল অনুভব করতে পারতেন;
  • অভিযুক্ত ব্যক্তি তার কোনো কাজের মাধ্যমে উক্ত নারীর গর্ভপাত করেছিলেন;
  • তিনি (অভিযুক্ত ব্যক্তি) স্বেচ্ছায় এই কাজটি করেছিলেন;
  • কাজটি গর্ভপাত ঘটানোর উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল অন্য কোন কারনে নয় (যেমনঃ গর্ভবতী নারীর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে নয়)
  • এই কাজের ফলে গর্ভবতী নারীর মৃত্যু ঘটেছিল।

বাংলাদেশের গর্ভপাত সংক্রান্ত আইনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এতে একমাত্র গর্ভবতী নারীর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য সকল প্রকার গর্ভপাতকে অবৈধ বলে ঘোষনা করা হয়েছে। এমন কি গর্ভবতী নারীর ব্যক্তিগত মতামতকেও গ্রহণযোগ্য করা হয়নি। তবে অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার অধিকার পেতে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে (যেমনঃ ধর্ষিত নারী কিংবা স্বামী পরিত্যক্ত নারীর বেলায়) গর্ভপাত করার বিষয়টি সরকারের বিবেচনার দাবি রাখে।

[yottie id=”12″]